গণভোট নিয়ে বিভ্রান্তিতে সাধারণ মানুষ
ডিবিএন প্রতিবেদক
- আপডেট সময় ১১:২৪:৪১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫
- / ৯ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশে ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে ১৫ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সের সাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ প্রায় ৬১ শতাংশ। এর মধ্যে যারা সাক্ষর ভোটার, তারা গণভোটে ‘হ্যাঁ-না’ ভোট দিতে পারলেও বিষয়গুলো বুঝতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশে যেভাবে গণভোটের কথা বলা হয়েছে তাতে জনগণের মতামতের সঠিক প্রতিফলন ঘটবে কি না, তা নিয়ে সৃষ্ট সংশয় এখনো কাটেনি।
এ নিয়ে রাজনীতিবিদদের একাংশ বলছেন, প্রশ্নের যে নমুনা এবং যা করণীয়, সেটা চৌকস ভোটারদেরও হিমশিম খেতে হবে, আর নিরক্ষর ভোটাররা কী করবেন, সে-তো বুঝাই যায়। আরেক অংশ বলছেন, দলগুলো ঠিকঠাক ক্যাম্পেইন করলে মানুষ বুঝে নিতে পারবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কঠিন হবে কিন্তু সম্ভব।
অন্যদিকে, নির্বাচন ও আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে চার প্রস্তাব বা প্রশ্নে গণভোট হতে যাচ্ছে তা দেশের অধিকাংশ মানুষের জানা-বোঝার বাইরে। ভোটারদের এ বিষয়ে সচেতন করতে হলে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। আর কোন ভোটার গণভোটের চারটি প্রশ্নের মধ্যে কোন একটিতে দ্বিমত পোষণ করেন, সেক্ষেত্রে ভোটারের সেই অধিকারের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। অর্থাৎ গণভোটে প্রত্যেক ভোটারকে চারটি প্রশ্নের ক্ষেত্রে হয় ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিক্সের (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৫ বছরের এবং তার বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে সাক্ষরতার হার প্রায় ৬০ দশমিক ৭৭ শতাংশ। অর্থাৎ আনুমানিক ৩৯ দশমিক ২৩ শতাংশ মানুষ সাক্ষর নয়। সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট নিবন্ধিত ভোটারের সংখ্যা ১২ কোটি ৭৬ লাখ ১২ হাজার ৩৮৪। এই বিশাল সংখ্যক ভোটারের মধ্যে নিরক্ষর ভোটারের সংখ্যা অনেক।
এই পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানান, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোটের আয়োজন করা হবে। চারটি বিষয় পাঠ করে একটি হ্যাঁ বা না ভোট দেবেন ভোটাররা।
সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার পাশাপাশি যে চারটি বিষয়ের ওপর গণভোট হবে, সেগুলোও পাঠ করেন প্রধান উপদেষ্টা। কিন্তু তারপর থেকে একটি প্রশ্ন বড় করে দেখা দিয়েছে কত সংখ্যক ভোটার আসলে পড়তে জানেন? যারা পড়তে জানেন না তারা এই বিষয়ে কীভাবে ভোট দেবেন? বা যারা পড়তেও জানেন, তারা এই চারটি বিষয় বুঝতে সক্ষম কিনা।
তবে এই বুঝতে পারা না পারার বিষয়টি নিয়ে কেউ কেউ বলছেন, যে দেশের মানুষ ৬৯ সালে ১১ দফা বুঝতে পেরেছে, জিয়াউর রহমানের ১৯ দফার ওপরে গণভোটে অংশ নিয়েছেন, সে দেশে চারটি বিষয় বুঝে নিতে পারবে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক তাঁর প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেছেন, জাতীয় জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশে যেভাবে যেসব প্রস্তাবে গণভোটের আয়োজনের কথা বলা হয়েছে তার জন্য ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। বেশিরভাগ মানুষের জন্য এই মুহূর্তে সরকারের করণীয় একটাই, ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। রেডিও, টেলিভিশন, পত্রপত্রিকার মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চালিয়ে বিষয়টি বোঝাতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। মানুষ যদি বুঝতে না পারে তাহলে আমার ধারণা, অনেকেই এই ভোটে অংশগ্রহণ করবে না। সে ক্ষেত্রে কিভাবে ভোট দিতে হবে, এর প্রস্তাব বা প্রশ্নগুলো কী, সে সম্পর্কে জনসচেতনা তৈরি দরকার।
গণভোট বিষয়ে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মী ড. আব্দুস সালেহীন বলেন, ‘এই হ্যাঁ ও না ভোটের বিষয়বস্তুগুলো, এ নিয়ে কতটুকু মাত্রায় নাগরিকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। কনসেপচুয়ালি যে চারটা বিষয়ের ওপর তারা হ্যাঁ বা না ভোটের আলাপটা তুলছেন, সেক্ষেত্রে দেখার বিষয় বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে এগুলো কতটুকু পৌঁছেছে। কিংবা যে বিশাল অংশের মানুষ আসলে হ্যাঁ আর না-এর বাইরেও যে বড় আলাপ-আলোচনা আছে, সে বিষয়গুলো বুঝতে পারবেন না, তাদের কী হবে। সেক্ষেত্রে এটাও একটা প্রশ্ন যে, গণভোটের জন্য বাংলাদেশের মানুষ কতটা প্রস্তুত। তাদের প্রস্তুত করার জন্য যথেষ্ট সময় এই অন্তর্বর্তী সরকার পাবে কিনা। সেটা নিয়েও একটা বড় প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।’
যদিও গণভোট কঠিন হলেও সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, ‘দেড় বছর ধরে মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা অনেক বেড়েছে। তারা বিটিভিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভা নিয়মিত না হলেও দেখেছেন এবং এর কার্যক্রম ও আলোচনার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। এছাড়া প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এই বিষয়গুলো নিয়ে প্রচার-প্রচারণা হবে। সেসব বিবেচনায় নিলে বলা যায় বুঝে ভোট দিতে পারবে না, সেটা বলা যায় না।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘শুধু সরকার নয়, রাজনৈতিক দলগুলোকেও ক্যাম্পেইন করতে হবে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় গণমাধ্যমে বিষয়গুলো প্রচার করতে হবে। এর আগে জিয়াউর রহমানের আমলে তো ১৯ দফাতে গণভোট হয়েছে। ফলে এটা অসম্ভব হওয়ার কারণ নেই। সামনে আরও প্রচার হবে। যে মানুষ পড়তে পারে না, প্রচার-প্রচারণার মধ্য দিয়ে তারা বুঝে নেবে।’
গণভোটে যে চার বিষয়ে একটি হ্যাঁ বা না উত্তর দিতে হবে, সেগুলো হলো- ক. নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে। খ. আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।
তৃতীয় প্রশ্নে রয়েছে- গ. সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে। ঘ. জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।
গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট ‘হ্যাঁ’ সূচক হলে আগামী সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ গঠিত হবে বলে ঘোষিত জুলাই আদেশে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, এই নির্বাচিত প্রতিনিধিরা একই সঙ্গে জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। পরিষদ তার প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ হতে ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। সংবিধান সংস্কার হওয়ার পর ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতে উচ্চ কক্ষ গঠন করা হবে। এর মেয়াদ হবে নি¤œকক্ষের শেষ কার্যদিবস পর্যন্ত।
স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে দেশে মোট তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে দুটি প্রশাসনিক গণভোট এবং আরেকটি সাংবিধানিক গণভোট। এই তিনটি গণভোটেই একটি প্রশ্নের ওপর সম্মতির জন্য করা হয়েছিল। প্রথম গণভোট হয়েছিল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৭ সালের ৩০ নভেম্বর। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে বৈধতা দিতে অনুষ্ঠিত ওই গণভোটে ৯৮ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষই ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়েছিল।
১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ দেশে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময়ে।
তার নীতি ও কর্মসূচি এবং স্থগিত সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি হিসাবে তার দায়িত্ব পালনের বিষয়ে জনগণের আস্থা আছে কি-না, তা যাচাইয়ের জন্য ওই গণভোট অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তৃতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। ‘তিন জোটের রূপরেখা’ অনুযায়ী জাতীয় সংসদে গৃহীত সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠার পর সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বে থাকা প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সম্মতি দেবেন কি না, সে প্রশ্নে দেশব্যাপী গণভোট আয়োজনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ওই গণভোটে একটি কোটি ৮৩ লাখ ৮ হাজার ৩৭৭ জন ভোটার সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে, অর্থাৎ ‘হ্যাঁ’ ভোট দেন।
চতুর্থ গণভোট আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও ভোটারদের উৎসাহিত করতে রাজনৈতিক দলগুলো কতটা উদ্যোগ নেবে এ বিষয়ে অনেকের সংশয় রয়েছে। তাদের মতে, বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের ভোটারদের একটা বড় অংশ নির্বাচনী প্রতীক দেখে এতকাল ভোট দিতে অভ্যস্ত ছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে চার প্রশ্ন পড়ে কীভাবে তারা ভোট দেবেন, সেই আলোচনা রাজনৈতিক অঙ্গনে এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে।
গণভোটের চারটি প্রশ্নের কোনো একটার সঙ্গে দ্বিমত থাকলে, সেখানে ‘না’ বলার সুযোগটা কোথায়? সরকারের কাছে প্রশ্ন রেখে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী শনিবার বলেন, ‘গোঁজামিল দিয়ে কোনো কিছু করা হলেও তা টেকসই হবে না।
৯০ ভাগ মানুষ যদি বুঝতে না পারে গণভোটের উদ্দেশ্য কী, তাহলে সেই তিমিরে মানুষ থেকে যাবে। সাধারণ মানুষ যেন বুঝতে পারে, সেই আলোকে গণভোটের প্রশ্নমালা করতে হবে। গণভোটে যে চারটা প্রশ্ন রয়েছ সেখানে ‘না’ এর অপশন নেই। একমত হতে না পারলে সেই মতামত জনগণ কীভাবে দেবে- তা উল্লেখ নেই গণভোটে।
সুত্র জনকন্ঠ












